বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান ও প্রবন্ধ গ্ৰন্থ গুলির সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য Bankimchandra's Contributions to Bengali Essay Literature
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান ও প্রবন্ধ গ্ৰন্থ গুলির সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য
Bankimchandra's Contributions to Bengali Essay Literature and Brief Features of Essays
‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকা অবলম্বনে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল
1838 সালের 27জুন 24 পরগনা জেলার
কাঁঠাল পাড়া গ্রামে তিনি
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর
পিতা ছিলেন যাদব চন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় প্রথম
দিকে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক
সরকারের একজন কর্মকর্তা, পড়ে
হুগলির ডেপুটি কালেক্টর হন। 1858 সালে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ব্যাচে যে
দুজন ছাত্র বিএ পাস
করেন বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাদের মধ্যে
একজন। তিনি তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ
করে নিম্ন নির্বাহি চাকরিতে যোগ
দেন (সাব-অর্ডিনেট এক্সিকিউটিভ সার্ভিস) এবং
পরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও
ডেপুটি কালেক্টর পদের দীর্ঘদিন চাকরি
করেন।
বঙ্গদর্শন' পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন | ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকার সম্পাদন করেন । বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির বিষয় ছিল সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজনীতি, ধর্মকথা, দর্শন, শিল্পতত্ত্ব, শাস্ত্রগ্রন্থ প্রভৃতি। Bengali Literature (1871) প্রবন্ধটি বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা। 'TheCalcuttaReview' পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এই প্রবন্ধে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেন প্রবন্ধকার বঙ্কিমচন্দ্র। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও লঘু কৌতুক এবং স্বদেশ চিন্তাবিষয়ক ছিল লোকরহস্য গ্রন্থের বিষয়বস্তু । ইংরেজ সাহিত্যিক ও সমালচক ডি-কুইসের (১৭৮৫-১৮৫৯) 'Confessions of an English Opium Eater'-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি
বঙ্কিমচন্দ্রের
সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলিকে দুই-টি শ্রেণিতে ভাগ
করা যায়। যেমন—সাহিত্য রূপকল্প ও সাহিত্য সমালোচনা। তিনি যে সকল প্রবন্ধ
গ্রন্থগুলি রচনা করে ছিলেন
সে গুলি হোলো- ‘লোকরহস্য'
(১৮৭৪), 'বিজ্ঞানরহস্য' (১৮৭৫), কমলাকান্তের দপ্তর'
(১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), 'সাম্য' (১৮৭৯), প্রবন্ধ পুস্তক'
(১৮৭৯), 'কৃষ্ণচরিত্র' (১৮৮৬), ‘বিবিধ প্রবন্ধ (প্রথম ভাগ,
১৮৮৭), ‘ধর্মতত্ত্ব (১৮৮৮), ‘বিবিধ প্রবন্ধ (দ্বিতীয়
ভাগ-১৮৯২), শ্রীমদ্ভাগবদগীতা (প্রচারে’ ১২৯২ ও ১২৯৫
বঙ্গাব্দে মুদ্রিত)।
বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম ভাগ ১৮৮৭
খ্রিস্টাব্দে (১৩৪৬ সাল) প্রকাশিত । এবং বিবিধ প্রবন্ধ দ্বিতীয়ভাগ
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫১ সাল) প্রকাশিত হয় ।
ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধ রচনা
বঙ্কিমচন্দ্র
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের নব্য বাংলা ও
বাঙালির চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সমাজ,
ধর্ম, মনন—সমস্ত কিছুকে
নিজের কক্ষপথে টেনে এনেছিলেন।
তার জন্য তিনি প্রবন্ধকে বেছে নিয়েছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ চর্চার গুরুত্ব
নানা প্রবন্ধের সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালিকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তদানীন্তন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি বলে তাঁকে অভিহিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কোন ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের মত বাঙালির জীবনে গভীরভাবে নিজ মন ও মনন এবং ব্যক্তিত্বের ছাপ মুদ্রিত করে দিতে পারেননি। সর্বোপরি তিনি নিজে শুধু প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালির চিত্তবিকাশে সাহায্য করেননি, তাঁর চারিদিকে একদল বুদ্ধিমান শিষ্য তৈরি করে তাঁদের সাহায্যেও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সবিশেষ উন্নতি করেছিলেন।
কমলাকান্তের
দপ্তর গ্ৰন্থখানির সংক্ষিপ্ত
বৈশিষ্ট্যগুলি
কমলাকান্তের
দপ্তর ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টাব্দে
প্রকাশিত হয় ভাষার মাধুর্যে,
ভাবের মনোহারিত্বে, শুভ্র সংযত সরস
রসিকতায়, অকৃত্রিম স্বদেশেপ্রেমে গ্রন্থটি বঙ্গাসাহিত্যের গৌরব । হাসির
সঙ্গে করুণের, অদ্ভুতের সঙ্গে সত্যের, তরলতার
সঙ্গে মমদাহিনী জ্বালার,
নেশার সঙ্গে তত্ত্ব বোধের,
ভাবুকতার সঙ্গে বস্তুতন্ত্রতার, শ্লেষের
সাথে উদারতার এমন মননামোহন সমন্বয় বিরল । ‘কমলাকান্তের
দপ্তর -এর অন্তর্ভুক্ত পতঙ্গ’, ‘মনুষ্যফল’, ‘পেঁকি’, ‘বড়বাজার’ প্রভৃতি প্রবন্ধে রচনায়
বঙ্কিমচন্দ্রের মানব জীবন সম্পর্কিত ।
কমলাকান্তের দপ্তর’-এর : বিড়াল' প্রবন্ধে প্রবন্ধের
মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রবাদ
ও ধনতন্ত্রবাদের মতবাদ যুক্তি সহকারে বিশ্লেষিত হয়েছে । রচনায় আঙ্গিক, অভিনব
অর্থাৎ ব্যঙ্গরসাত্মক লঘু নকশার আকারে
ভাবনা-চিন্তার ফলে এতে প্রবন্ধ শিল্পের প্রচলিত গঠন বা অকারসৌষ্ঠব
বঞ্চিত হয়নি।
কমলাকান্তের
দপ্তরের চারটি বিখ্যাত চরিত্র
ছিল
শেগুলি কমলাকান্ত স্বয়ং, ভীষ্মদেব গোসনৰীশ, নসীরামবাবু ও প্রসন্ন গোয়ালিনি
। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’
গ্রন্থের মৌলিকতা আলোচনা করতে গিয়ে
বলতে হয় ‘কমলাকান্তের দপ্তর'
বঙ্কিমের একটি উচ্চস্তরের প্রবন্ধ
গ্রন্থ। এর
মধ্যে যারা ডি-কুইনসের
রচনার সাদৃশ্য
খোঁজেন তাঁরা বহিরঙ্গাকেই অধিক
গুরুত্ব দেন। রচনাটির
মৌলিকতায় সন্দেহ করা চলে না। কমলাকান্তের
মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের নির্জন ব্যক্তিসত্তার আর্তি
ধ্বনিত। গদ্য
ভাষাকে নমনীয়করে কতটা গীতিঝংকারের সৃষ্টি
করা যায় বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের
দপ্তরে তা দেখিয়েছেন। এবং বিদ্রুপাত্মক
ভাষার শাণিত তিরে এবং
উদ্ভট কল্পনার রূপবিলাসে সামাজিক বিচিত্র অসংগতি জাতীয়
চরিত্রের নানা দুর্বলতা তীব্র
আঘাত পেয়েছে। কমলাকান্তের দপ্তর' গ্রন্থের প্রবন্ধ
দুটিতে মানবজীবনের বহুবিধ চিত্ত বিক্ষোভ
এক সৰপ্লাৰী উদ্দীপনা সহকারে আত্মপ্রকাশিত।
রচনার প্রেক্ষাপটে একটি গভীর দার্শনিক
ভাবাদর্শ প্রচ্ছন্ন ওবঙ্কিমের ব্যক্তিচৈতন্যের সুনিবিড় স্পর্শ প্রকট।
বাংলা প্রবন্ধ
সাহিত্যে
বঙ্কিমচন্দ্রের
অবদান
বঙ্কিমচন্দ্রের
আবির্ভাবে প্রবন্ধ সাহিত্যে চিন্তাপ্রধান এবং রসপ্রধান উভয়
ধারার বিশেষ উন্নতি ঘটে। বঙ্কিমের সৌন্দর্যপ্রধান প্রবন্ধ লোকরহস্য ব্যঙ্গরসে এবং
কমলাকান্ত কখনও রোমান্টিক উপলদ্ধিতে সার্থক। সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃতানুগ
ধারাটি অস্বীকার করে ইংরেজি রোমান্টিক
সমালোচনার ধারাটি নিয়ে এলেন। ঐতিহাসিক
ও পুরাতাত্ত্বিক প্রবন্ধে তিনি উদারমুক্ত মনোভাব
এবং বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টি
তথা গভীর স্বদেশপ্রেমের পরিচয়
দিয়েছেন। অর্থনৈতিক
প্রবন্ধে সাম্যবাদের পক্ষে মত আর নিষ্কাম
কর্মের আদর্শ প্রচার তাঁর
শেষের দিকের প্রবন্ধের লক্ষ্য। স্বাজাত্যানুরাগ
বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙ্গালার ইতিহাস' প্রবন্ধে প্রবন্ধে ব্যক্ত ।
লোকরহস্য
গ্রন্থের
বিষয়বস্তু
‘লোকরহস্য’র প্রবন্ধগুলি সমাজব্যঙ্গমূলক। এগুলিতে
বিষয়বস্তু অপ্রধান না হলেও রচনা- রসসম্ভোগও
সমান গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তাকে
এখানে ব্যঙ্গ ও কৌতুকরসে
রূপান্তরিত করা হয়েছে।
এগুলির রঙ্গরস
মাঝে মাঝে বেশ তীব্র
হয়ে উঠেছে । অসঙ্গত
কল্পনা, উদ্ভট পরিস্থিতি, রঙ্গাত্মক
অতিরঞ্জন এইসব
রচনায় হাস্যরসের কারণ হয়ে উঠেছে। উনবিংশ
শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে
যে ব্যঙ্গাত্মক নকশার
প্রচলন হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এ রচনায় তা
উৎকর্ষের চরমে উঠেছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য
সমালোচনা মূলক প্রবন্ধ
উত্তর
রামচরিত, ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব', 'শকুন্তলা'
'মিরান্দা ও দেদিমোনা'
প্রভৃতি। অলংকার প্রয়োগ দ্বারা রচনার ভাব
বা রূপগত সংগতি ক্ষুপ্ত
করা হয়নি। বিতর্কমূলক
প্রতিপাদ্য বিষয়ও তিনি
দৃঢ়ভিত্তিক যুক্তির সহায়তায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার
সৰ প্ৰবারেই ব্যৰিবয় পরিবেশন গুণে সুস্পষ্ট এবং
মননদীপ্ত হয়েছে। দুরূহ
সমস্যামূলক বিষয়ও অস্পষ্ট জটিল
প্রবিধহয়ে পড়েনি।
COMMENTS