মনসামঙ্গল কাব্য অবলম্বনে কবি বিজয় গুপ্তের কবি প্রতিভার পরিচয় দাও?
মনসামঙ্গল কাব্য অবলম্বনে কবি বিজয় গুপ্তের কবি প্রতিভার পরিচয়
মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় কবি বিজয় গুপ্ত।কবি বিজয় গুপ্তের জন্মস্থান বরিশাল জেলার গৈলাফুল্লশ্রী গ্রাম।
কবি বিজয় গুপ্তের ব্যক্তিগত পরিচয় সূত্রে জানা জায়-কবিরা ছিলেন বৈষুব। বৈদ্য পরিবারে কবির জন্ম। পিতার নাম সনাতন, মাতা রুক্মিণী। কথিত আছে, বিজয় গুপ্ত নিজের গ্রামে মনসার মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। কবির পরিবারে সংস্কৃত-চর্চা হত। ব্যক্তিগত পরিচয় দিতে গিয়ে কবি জন্মভূমি ফুল্লশ্রীকে পণ্ডিত নগর বলেছেন।
১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিজয় গুপ্ত তাঁর কাব্য রচনা করেন। এই সময়ে বাংলার রাজা ছিলেন হুসেন শাহ।‘পদ্মপুরাণ' ছিল বিজয় গুপ্তের কাব্যের নাম।বিজয় গুপ্তের কাব্যে যে সকল চরিত্র স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে সে গুলি হল- চাঁদ সদাগর, সনকা, বেহুলা ও মনসা প্রভৃতি চরিত্র স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
মনসামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্যঃ-
বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। কাহিনিচয়ন, চরিত্রচিত্রণ ও সমাজজীবনের প্রতিবিম্বনে বিজয়গুপ্ত দেবমাহাত্ম্যকে অবাস্তব কল্পনা রাজ্যের বিষয়বস্তু করে তােলেননি। তীক্ষ সমাজচেতনা ও প্রগাঢ় বাস্তব জীবনবােধ তাঁর কাব্যের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
মনসামঙ্গল কাব্য-রচয়িতা হিসেবে কবি বিজয় গুপ্তের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলতে হয়- বিজয় গুপ্তের বড়াে কৃতিত্ব সমাজসচেতন প্রখর বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি। সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রকে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত করেছেন। সে যুগের আচারব্যবহার, রীতিনীতি,
পােশাকপরিচ্ছদ, আহার ও রন্ধন প্রণালী প্রভৃতি বিষয়কে তিনি খুবই নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
মনসার চরিত্রাঙ্কনে বিজয় গুপ্তের কৃতিত্বের পরিচয় ঃ-
প্রচণ্ড হিংসা ও নির্মম কুরতার এক দাবদাহ চরিত্র মনসা। একটি দেবী চরিত্রকে এরূপ নির্জলা অসদগুণের অধিকারী করে তােলার পিছনে কবি যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণগুলি মনসার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে পরিস্ফুট করেছেন। নিজ জীবনের অপরিসীম নৈরাশ্যবােধ থেকেই মনসা বিবেক বুদ্ধিহীন নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন। বাস্তব চরিত্র হিসেবে চরিত্রটি পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণ করে।
১০ ‘বেহুলা' চরিত্র সৃষ্টিতে বিজয় গুপ্তের কৃতিত্ব কী ? ও হৃদয়ের সমস্ত সহানুভূতি উজাড় করে দিয়ে সমস্ত মাধুর্য ও পবিত্রতা ঢেলে দিয়ে কবি সৃষ্টি করেছেন বেহুলা চরিত্রটিকে। বেহুলার সৌন্দর্য বর্ণনা শিল্প সৌকর্যে রমণীয়, সতীত্বে, পবিত্রতায়, মাধুর্যে ও রঙ্গরসে বেহুলা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। বেহুলার সুদৃঢ় চরিত্র, কর্তব্যবােধ ও পাতিব্ৰত্য বর্ণনায় বিজয় গুপ্ত কোনাে ত্রুটি রাখেননি।
সনকা চরিত্র-পরিকল্পনায় কবি বিজয় গুপ্তের কৃতিত্ব ঃ-
সনকা চরিত্র-পরিকল্পনায় মাতৃহৃদয়ের বেদনাকে বিজয় গুপ্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিয়ের পর বাসর রাতে পুত্র মারা গেলে পুত্রবধুর প্রতি সনকার বিদ্বেষভাব জাগে। নারী মনস্তত্ত্বে এই বিদ্বেষভাব স্বাভাবিক। তারপরই আবার পুত্রবধূকে কোলে নিয়ে ‘হিয়া হানে চুল ছেড়ে ধরণি লুটায়।
বিজয় গুপ্তের হাতে চাঁদের চরিত্র বহুস্থলে ক্ষুন্ন হয়েছে'—উক্তির তাৎপর্য ঃ-
চাঁদ সদাগর চরিত্র সৃষ্টিতে বিজয় গুপ্ত আনুপূর্বিক সামগ্রিকতা বা সংহতি রাখতে পারেননি। মনসার বিরুদ্ধাচরণ ও সর্বপ্রকার বিপদের মুখে চাঁদ সংকল্পের দৃঢ়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ। কবির প্রকৃতি ছিল বিশ্লেষণাত্মক, তিনি কাহিনি গ্রন্থনে ও চরিত্র সৃষ্টিতে সামগ্রিকতা সৃষ্টির কৌশল জানতেন না। সমালােচকের মতে, ঐক্য অপেক্ষা বৈচিত্র্য এবং সংহতি অপেক্ষা স্বয়ংসম্পূর্ণ সৃষ্টির প্রতি প্রবণতা থাকায় চাঁদ চরিত্রে ভারসাম্যের অভাব ঘটেছে। তাঁর (চাঁদ) পৌরুষ বীর্য ক্ষুন্ন হয়েছে।
কাব্যরস বিচার ঃ-
বিজয় গুপ্তের কাব্যে অঙ্গীরস বা প্রধান রসের (করুণ) সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে হাস্যরসেরও অবতারণা ঘটেছে। কবিধর্মে নয়, যুগধর্ম ও জনরুচির আনুগত্য স্বীকার করে তিনি হাস্যরসাত্মক বর্ণনার অবতারণা ঘটিয়েছেন। Wit এবং Fun-এর প্রকাশ ঘটেছে বেশি। করুণ রস অপেক্ষা হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতে বিজয় গুপ্তের কৃতিত্ব সমধিক।
কবি প্রতিভার পরিচয় ঃ-
বিজয় গুপ্ত সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। তাই তাঁর রচনায় বৈদগ্ধ্য বেশি। জীবনের শিল্প রূপায়ণে তিনি খুব সচেতন। ছন্দ প্রয়ােগে ও অলংকার সৃষ্টিতে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল প্রশংসনীয়। তাঁর কাব্যে কাহিনির ঐক্য বা সংহতির অভাবের ঘাটতি পূরণ করেছে ছন্দোবৈচিত্র্য, বাবৈদগ্ধ্য ও আলংকারিক কলা-কৌশল এবং দেশীয় শব্দচয়নের নৈপুণ্য। সব দিক দিয়ে বিচারে বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁকে বাদ দিয়ে মনসামঙ্গল কাব্যের আলােচনা করা যায় না ।
COMMENTS