বর্তমান ভারতের মানচিত্রে প্রাচীন ভারতের নদ-নদী Rivers of ancient India on the current map of India
বর্তমান ভারতের মানচিত্রে প্রাচীন ভারতের নদ-নদী
প্রাচীন ভারতের নদ-নদী
ভারতবর্ষ হল বহু নদীর আশ্রয়স্থল। নদ’ এবং নদী’ এই দুটি শব্দের মধ্যে অর্থগত কোনাে রকম পার্থক্য আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু নদ’ হল পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ এবং নদী’ হল স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ। এই অর্থে নীল, ব্রম্মপুত্র ইত্যাদি হল নদ। আর গঙ্গা, গােদাবরী ইত্যাদি হল নদী। ভূমিরূপের ভাস্কর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে নদনদীর গুরুত্ব সর্বাধিক। কেবলমাত্র নদীর কার্যের ফলে যে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটে তা নয়, মানুষের জীবনধারণ ও অর্থনৈতিক কার্যাবলির ক্ষেত্রেও নদীর প্রভাব অপরিসীম। সেই কারণে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাচীন সভ্যতার অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা ইত্যাদি নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল।ভারতের কয়েকটি প্রধান নদনদী সম্পর্কে উল্লেখ করা হল।
গঙ্গা:- প্রাচীনকাল থেকেই গঙ্গা ভারতের শ্রেষ্ঠ নদী, তাই ভারতীয়দের কাছে এই নদীর মহত্ত্ব অপরিসীম। (২৬.৭) নরসিংহ-পুরাণে বর্ণিত সূর্যবংশীয় রাজা অংশুমানের পুত্র ভগীরথ কঠিন তপস্যার দ্বারা গঙ্গাকে পৃথিবীতে আনয়ন করেন।(৯৬.১১) দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে সরস্বতীর শাপে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন। পুরাণে জম্বুদীপ ভারতবর্ষের অন্তর্গত গঙ্গানদীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে যে গঙ্গ বিষুর পদযুগল থেকে উৎপন্ন হয়ে স্বর্গলােক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্ৰহ্লাপুরীতে পতিত হয়েছে। তারপর চারিদিকে সীতা, অলকানন্দা, চক্ষু ও গলা নদী ভদ্রা নামে বিভক্ত হয়েছে। সীতা এই ভাগটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ভদ্রাশ্ববর্ষে (চিনে) প্রবেশ করে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। অলকানন্দা শাখাটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে জম্বুদীপে প্রবেশ করে 7 ( সাত ) ভাগে বিভক্ত হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। চক্ষুধারা পশ্চিমদিকে প্রবাহিত হয়ে কেতুমালবর্ষে (পশ্চিম এশিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ) প্রবেশ করে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। আর ভদ্রা উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে মিলিত হয়েছে সমুদ্রে ।
গঙ্গা ভারতের দীর্ঘতম নদী যার দৈর্ঘ্য ২,৫১০ কিমি। এর মধ্যে ২,০১৭ কিমি ভারতবর্ষের মধ্যেই প্রবাহিত। এই নদী কুমায়ুন হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গােমুখ গুহা থেকে উৎপন্ন হয়ে ভাগীরথী নামে সংকীর্ণ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পরে দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং এই দুটি মিলিত স্রোত গঙ্গা নামে পরিচিত। যা পরে শিবালিক পর্বত অতিক্রম করে হরিদ্বারের কাছে সমভূমিতে অবতরণ করেছে। বিহারের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রাজমহল পাহাড়ের কাছে (নিম্নগতি) পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করার পর কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার মিঠিপুরের কাছে ভাগীরথী ও পদ্মা (বাংলাদেশে) নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়েছে। গঙ্গার ভাগীরথী’ এই শাখাটি ভাগীরথী-হুগলি নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
নর্মদা:- বৃষ্টির জলে পুষ্ট ও আরবসাগরে পতিত নদী যার দৈর্ঘ্য ১,৩১০ কিমি। এই নদী মহাকাল পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অমরকন্টক থেকে উৎপন্ন হয়ে মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মধ্য দিয়ে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের সংকীর্ণ গিরিখাত
অতিক্রম করে খাম্বাত অর্থাৎ কাম্বে উপসাগরে পড়েছে। কঠিন শিলাস্তর অতিক্রম করার জন্য অনেকগুলি জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে।
শতদ্রু :- প্রাচীন কালের শতুদ্ৰী নদীই আধুনিক শতদ্রু নদী নামে পরিচিত। এই নদী পাঞ্জাবে অবস্থিত পঞনদীর অন্যতম। এই নদী মানস সরােবরের নিকটস্থ জলধারা থেকে উৎপন্ন হয়ে ফিরােজপুর, লুধিয়ানা ইত্যাদি শহরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিন্ধু নদীতে মিলিত হয়েছে। বর্তমানে শতদ্রর ভাকরা-নাঙ্গাল সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্পপাঞ্জাবে ও হিমাচল প্রদেশে শস্য উৎপাদনে বিরাট পরিবর্তন এনেছে।
বিপাশা:- হিমালয়ের তরাই অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে পাঞ্জাব ও হিমাচলপ্রদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শতদ্রু নদীতে মিলিত হয়েছে। বিপাশা পাঞ্জাব প্রদেশে স্থিত পঞনদের একটি নদী যা বিয়াস নামে পরিচিত। এই নদীর তীরে প্রসিদ্ধ শিখ তীর্থ অমৃতসর অবস্থিত। এটি সিন্ধুনদের উপনদী গুলির মধ্যে একটি।
সরযূ :- পুরাণে উল্লিখিত সরযূ নদী বর্তমানে ঘর্ঘরা নামে পরিচিত। নরসিংহ পুরাণ অনুসারে এই নদীর তীরেই বিখ্যাত অযােধ্যা নগরী অবস্থিত। সরযূ অর্থাৎ ঘর্ঘরা নদী বর্তমানে নেপালের তকাকোর্ট-এর ৩৭ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মঙ্গাতুঙ্গ (হিমানী) থেকে উৎপন্ন হয়ে বিহারের সারণ তথা, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সীমার কাছে গঙ্গানদীতে মিলিত হয়েছে। ঘর্ঘরা গঙ্গার বামতীরের উপনদীগুলির মধ্যে একটি। ঘর্ঘরার তীরে লিগােদাম, ফৈজাবাদ, বহলগঞ্জ, দাপরা ইত্যাদি বিখ্যাত শহর গড়ে উঠেছে।
যমুনা:- নরসিংহ পুরাণে বর্ণিত হয়েছে যে আদিত্য ও সংজ্ঞার ল্যা যমী, যিনি বৈবস্বত মনু ও যমের ভগিনী ছিলেন। কিন্তু বিমাতা হায়ার অভিশাপে যমী যমুনা’ নামে নদীতে পরিণত হয়েছিলেন। আবার এই পুরাণে অন্যত্র বলা হয়েছে যে বালক ধ্রুব বিমাতা সুরুচির দ্বারা অপমানিত হয়ে নারদমুনির আশীর্বাদ লাভ করে যমুনার তীরে মধুবনে তপস্যা করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃয় এই নদীতে বিষধারী কালীয় নাগ মন করেছিলেন। তাই এই নদীর আর-এক নাম কালিন্দী।
গোদাবরী :- পুরাণ কাহিনি অনুযায়ী গােদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী বন অবস্থিত ছিল। যেখানে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসকালে অবস্থান করতেন। মহাভারতে বলা হয়েছে যে,এই নদীতে নিয়ত স্নান করে মানুষ মহাপুণ্যবান হয় এবং দেবলােক প্রাপ্তি ঘটে। আধুনিককালে, দক্ষিণ ভারতের দীর্ঘতম নদী গােদাবরী, যার দৈর্ঘ্য ১,৪৬৫ কিমি। এই নদী মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে ৬৪ কিমি দূরে অবস্থিত। সহ্যাদ্রি অর্থাৎ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার অন্তর্গত এ্যম্বক বা ব্রিম্বক পাহাড়ের ১,৬০০ মিটার উচ্চতা থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সাতভাগে বিভক্ত হয়েছে এবং সপ্তগগাদাবরী নামে বদ্বীপ সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
সিন্ধু:- সিন্ধু তিব্বতের মানস সরােবরের নিকট ৫১৮০ মিটার উচ্চতায় কৈলাস পর্বতের নিকট সিন-কা-বাব (সিঙ্গ খাবার) নামক তিনটি জলধারার মধ্যে একটি জলধারা, যার থেকে উৎপন্ন হয়ে আটক শহরের নিকট প্রায় সমতল ভূমিতে নেমেছে এবং আরব সাগরে পতিত হয়েছে, সেই সঙ্গে একটি বদ্বীপ তৈরি হয়েছে। উৎসস্থল থেকে এই নদী উত্তর পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। সিন্ধু নদের পাঁচটি উপনদী হল শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা। সবগুলি ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানে সিন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
COMMENTS