ষােড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ এর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
ষােড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ এর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
ষােড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ এর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের জন্মস্থান বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে।মুকুন্দরামের পিতা- হৃদয় মিশ্র,মাতা- দৈবকী ।মেদিনীপুরের ব্রাক্ষ্মণভূমির জমিদার বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায় মুকুন্দরামকে ‘কবিকঙ্কণ’ উপাধি দেন। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে কবি তাঁর কাব্য (অভয়ামঙ্গল) রচনা করেন।এবং পরবর্তী সময়ে ‘অভয়ামঙ্গল'-ই অধিক ব্যবহৃত বা বহুলপ্রচারিত। এছাড়া, ‘অম্বিকামঙ্গল',‘গৌরীমঙ্গল’ প্রভৃতি নামগুলিও পাওয়া যায়।
কবির ছাত্র তথা জমিদার রঘুনাথ রায়ের অনুরােধে কাব্য রচনা শুরু করেন।কবির আত্মজীবনীতে সমকালীন রাষ্ট্রিক ইতিহাস ও বাস্তব সমাজচিত্র এবং কবির ব্যক্তিগত দুঃখ দুর্দশাময় জীবনের অকৃত্রিম পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে।পূর্বের সকল কবিদের থেকে অনেক মার্জিত ও অলংকার সমৃদ্ধ। ভাবার্থ ও শব্দার্থের মধ্যে নৈকট্য স্থাপনে, বর্ণনার প্রাঞ্জলতা, উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহারে, লৌকিক আবহ সৃষ্টিতে তিনি যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।
আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—চরিত্র সৃষ্টি। মুকুন্দরাম চরিত্র সৃষ্টিতে সূক্ষ্ম-দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে, বাস্তবরসের সংযােজন ঘটিয়ে এ ব্যাপারে আশ্চর্য সাফল্য অর্জন করেছেন। কালকেতুর ব্যাধসুলভ Rustic । ব্যাধপত্নী ফুল্লরার যথার্থ পতিভক্তিপরায়ণতা, বাকচাতুর্যে অনন্যা। ভাঁড়ু দত্ত ও মুরারি শীলের শঠতা মুকুন্দের কৃতিত্ব। দক্ষ ভাস্কর্যশিল্পীর মতাে তিনি মানবচরিত্রের বিভিন্ন দিক উদঘাটিত করেছেন।
কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর এক অভিনব সৃষ্টি মুরারি শীল। এই চরিত্রটি মুকুন্দর পূর্বে রচিত হয়নি।এটা কবির মৌলিক সৃষ্টি। উপস্থিত বুদ্ধি, ধূর্ততা ও বাকনৈপুণ্যে মুরারি শীল অদ্বিতীয়। মুরারি শীল বাংলার শাইলক।
কাহিনি নির্মাণে কবি মুকুন্দরামের কৃতিত্ব
গতানুগতিক কাহিনিকে নবতর রূপদান করেছেন চণ্ডীমঙ্গলের মুকুন্দরাম। তাঁর কাহিনিতে বৈচিত্র্য সম্পাদনের মধ্যে তৎকালীন সমাজের মানুষের প্রতি বাস্তব দৃষ্টি , অসীম কৌতূহল ও শ্রদ্ধা সহকারে দারিদ্র লাঞ্ছিত মানুষের জীবন যাত্রার ছবি এঁকেছেন নিখুঁত ভাবে ।ও বাস্তববােধ ও জীবনবােধের ভাবগত সমন্বয়ে তাঁর রচনা রসােত্তীর্ণ হয়েছে।
মঙ্গলকাব্যকার হয়েও তিনি মানবতাবাদী , লােককান্ত কবি। সকল মানবের সুখ দুঃখের চিত্র তাঁর কাব্যে জীবন্ত। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের আরােপ ও জীবনরসের প্রাচুর্যে মধ্যযুগের মাটিতে দাঁড়িয়েও আধুনিক মানব ধর্মের প্রবক্তা কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। গুজরাট নগর পত্তনের সময় মুকুন্দরাম নতুন সমাজ সংগঠনের পরিচয় দিয়েছেন। তাতে সর্বধর্ম সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি ও সর্বজাতিক মিলনাদর্শ পরিস্ফুট। মুকুন্দরাম নিজে মুসলমান শাসক কর্তৃক বাস্তুচ্যুত হয়েও ব্যক্তির উর্ধ্বে উঠে যথার্থ কবির মতােই কারুর প্রতি বিদ্বেষ-ঘৃণা বা কোনােপ্রকার অনুদার মনােভাব পােষণ করেননি। জীবনরসিক কবি জীবনের রসসৃষ্টিতে সকলকেই সমদৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন।
মঙ্গলকাব্যধারায় মুকুন্দরামের প্রভাব নির্ণয়
মঙ্গলকাব্যধারায় মুকুন্দরামের প্রভাব বিপরীতমুখী হয়েছে। মুকুন্দরামের সমুচ্চ সাফল্যের পরে চণ্ডীমঙ্গল লিখে কবিখ্যাতি দুরূহ মনে করে অনেকেই এদিকে অগ্রসর হননি। অপরদিকে পরবর্তী শক্তিশালী কবি ভারতচন্দ্রও মুকুন্দরামের অনুসরণে স্বতন্ত্র কাহিনিকাব্য লিখেছেন। মুকুন্দুরামের পরের যুগের মঙ্গলকাব্যের অনেক কবি তাঁর আদর্শে আত্মজীবনী লিখেছেন, এ ঘটনাটিও লক্ষণীয়।
মুকুন্দরামের কাব্য অবলম্বনে তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের পরিচয় পাওয়া যায় আকবর-সেনাপতি মানসিংহ বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে।মুকুন্দরাম তাঁর আত্মবিবরণীতে মানসিংহের প্রশংসা করলেও তৎকালীন রাজকর্মচারীরা যে ভয়ংকর অত্যাচারী ছিলেন তার পরিচয়-ও দিয়েছেন। বেশি কর আদায়ের লােভে ডিহিদার মামুদ শরিফ এবং রায়জাদা ব্রাত্মণ ও বৈষুবদের উৎপীড়ন শুরু করেছিলেন। আদর্শ ভূস্বামী কেমন হবেন তার একটা রূপ কালকেতুর রাজ্যগঠনের মধ্য দিয়ে দেখানাে হয়েছে।
সামাজিক মানুষের সংঘাত বিক্ষুব্ধ জীবনের বাস্তব কাহিনি রূপায়ণে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য চরিত্র গুলি তুলে ধরেছেন—তাতেই তাঁর কবি প্রতিভা ঔপন্যাসিকের সমধর্মী হয়ে আধুনিক চেতনার স্বগােত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।মুকুন্দরাম কেবল সময়ের অভাব অতিক্রম করতে, অতীত প্রথার সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে, অলৌকিকতার হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করতে পারেননি বলেই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হতে পারেননি। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তার মধ্যে বর্তমান ছিল ।
COMMENTS