অষ্টদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্যের অন্যতম কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র।হুগলি জেলার অন্তর্গত ভুরশুট পরগনার পেঁড়াে গ্রামে ভারতচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন ১৭০৫ খ্রিস্
ভারতচন্দ্র রায়
অষ্টদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্যের অন্যতম কবি রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র।হুগলি জেলার অন্তর্গত ভুরশুট পরগনার পেঁড়াে গ্রামে ভারতচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যু বরন করেন । তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রে রাজসভার কবি ছিলেন।সার্থক শিল্পপ্রতিভার গুণে ভারতচন্দ্রের সৃষ্ট মনুষ্য চরিত্রগুলি প্রত্যক্ষও খুবই সজীব। ছন্দ, অলংকার ও প্রবচনবহুল বাগভঙ্গির সুষম প্রয়ােগে কবি মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অনুপ্রাস, যমক, উপমা, শ্লেষ, রূপক, ব্যজস্তুতি ও উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলংকারের সার্থক প্রয়ােগে, ভুজঙ্গ প্রয়াত, তােটক ও তােণক প্রভৃতি ছন্দের ব্যবহারনৈপুণ্যে এবং শ্লেষকৌতুকপূর্ণ তির্যক দৃষ্টিভঙ্গির পরিস্ফুটনে, বর্ণনার পারিপাট্যে, বৈচিত্র্যে ও মাধুর্যে অন্নদামঙ্গল অনন্য শিল্পমণ্ডিত সৃষ্টি। গঙ্গাকিশাের ভট্টাচার্য ইংরেজি ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাংলা সচিত্র পুস্তকরূপে ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যপ্রথম মুদ্রিত করেন।বৈষ্ণব বেশবাস ধারণের জন্য ভারতচন্দ্র ‘মুনি গোঁসাই' নামে পরিচিত হন ।‘অন্নদামঙ্গল কাব্যরচনাকালে ভারতচন্দ্র ‘গুণাকর উপাধি কখন পান , মৃত্যুর আগে ভারতচন্দ্র মিশ্রভাষায় ‘চণ্ডীনাটক লেখেন।
ভারতচন্দ্র ছিলেন সমাজ ও যুগসচেতনার কবি। যুগধর্মের জন্যই ভারতচন্দ্রের সময়ে দেশের জনসাধারণ দেবতার মাহাত্ম্য ও কৃপার প্রতি আস্থাভাজন ছিলেন না। কবি পুরাতনকে নামমাত্র গ্রহণ করে নতুনত্বের উদবােধন ঘটিয়েছেন। অন্নদামঙ্গল কাব্য পুরাতন যুগের শেষ ও নতুন যুগের শুরু।অন্নদামঙ্গল কাব্য তার জিবনের শ্রেষ্ঠ কাব্য । এই কাব্যটি তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল ।ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ মঙ্গলকাব্য কাঠামােয় নতুন জীবনচেতনার বার্তাবাহী। তিনি পুরাতন পাত্রে নতুন রস পরিবেশন করেছেন।তীক্ষ্ম তির্যকতা, হাস্যকৌতুক, অসংগতির চমকপ্রদ উজ্জ্বলতা, রঙ্গাব্যঙ্গের উতরােল উল্লাস, শানিত বাকভঙ্গি প্রভৃতি ভারতচন্দ্রের কবিপ্রতিভার লক্ষণীয় মুখ্য বৈশিষ্ট্য।
অন্নদামঙ্গল’-এর প্রধান চরিত্র গুলি - শিব, অন্নপূর্ণা, ব্যাসদেব এবং ঈশ্বরী পাটনি চরিত্র গুলি নিয়ে গঠিত ।এর মধ্য অনন্য সৃষ্টি সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র কোনটি ঈশ্বরী পাটনি। ঈশ্বরী পাটনি চরিত্রটি ভারতচন্দ্রের অনন্য কবিপ্রতিভার স্বাক্ষর। ঈশ্বরী পাটনির কণ্ঠে শােনা গেল বাঙালির চিরন্তন প্রাণের কথা—‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। দেবী অন্নদার কাছে গ্রাম্য অশিক্ষিত খেয়াপারের মাঝি ঈশ্বরী মুক্তি মােক্ষ ধনদৌলত আকাঙ্ক্ষা করেনি। সুবর্ণ সেঁউতিকে হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করে সে নিজের সন্তানের জন্য স্বাবলম্বন শক্তি প্রার্থনা করেছে। বাৎসল্যরসের রসিক সমগ্র বাঙালি জাতির মর্মোদঘাটন করেছেন ভারতচন্দ্র এই চরিত্রে।
আর একটি উল্লেক যজ্ঞ ব্যাসদেবের চরিত্রের মধ্যে কবি মানুষের কর্মশক্তি ও তাঁর সাধনা—‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন আদর্শকে জয়যুক্ত করেছেন। ব্যাসদেব যেরকম কোপন স্বভাব ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য তাতে সাধারণ মানুষের স্তরে তিনি নেমে এসেছেন।
ভারতচন্দ্রের কাব্যে যুগব্যাপী দেবতার ভণ্ডামী ও স্বেচ্ছাচারিতা ব্যঙ্গের কশাঘাতে নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। মধ্যযুগের পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার অন্তঃসারশূন্যতা, সামাজিক জড়ত্ব ও মিথ্যার প্রতি ভারতচন্দ্রের প্রাণের বক্রোক্তি অন্নদামঙ্গলে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শিবের প্রতি ছেলেদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও কৌতুক পরিহাসের অর্থ হল দেবতার প্রতি অবিশ্বাস, তার ভণ্ডামির মুখােশ খুলে দেওয়া।
অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্রের প্রযুক্ত প্রবচনগুলির মধ্যে কয়েকটি
(i) 'নগর পুড়িলে দেবালয় কী এড়ায়’ (i) মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ (iii) বড়াের পীরিতি বালির বাঁধ (iv) নীচ যদি উচ্চভাষে সুবুদ্ধি উড়ায়ে হাসে', (iv) খুন হয়েছিনু বাছা চুন চেয়ে চেয়ে (v) যার কর্ম তার সাজে অন্য লােকের লাঠি বাজে', (vi) ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন', (vii)‘সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর’ প্রভৃতি প্রবচনগুলি বাঙালি জীবনের শাশ্বত কথাকলিতে পরিণত হয়েছে।
“যে হৌক, সে হৌক ভাষা কাব্য রস লয়ে”রাজসভার কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র একথা বিশ্বাস করতেন। বাচনভঙ্গির চাতুর্য ও রূপসজ্জার পারিপাট্যের দিকে ছিল কবির দৃষ্টি। তাই তৎসম, দেশি ও ফারসি ভাষার মার্জিত প্রয়ােগে তিনি নিজস্ব ভাষাভঙ্গি বা স্টাইলের জগৎ তৈরি করে গেছেন।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্র কেন স্মরণীয় ?
ভারতচন্দ্র তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সরস রঙ্গব্যঙ্গ রচনারীতির জন্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে আলােক স্তম্ভের ন্যায় বিরাজমান। জীবনের অসংগত হাস্যমুখর ও কৌতুকপ্রবণ দিকটি তিনি আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রত্যক্ষ জীবনের ভূমিকায় দেবদেবীকে তিনি মাটির মানুষ করে তুলেছেন।
কবি ভারতচন্দ্রের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য কী ?
কবি ভারতচন্দ্র তাঁর কাল থেকে অনেকটা এগিয়ে আছেন। আধুনিকতার বাণী—যুক্তি, বুদ্ধি ও মানবতা হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতাে তাঁর কাব্যে দীপ্তি বিকীর্ণ করেছে। রাজসভার শব্দ ও ছন্দের ঘটা, অনুপ্রাস ও ব্যস্তুতির সমারােহ এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শৈল্পিক রসসৃষ্টিতে তিনি বিদগ্ধ নাগরিক রুচির পরিতৃপ্তি সাধন করেছেন। তিনি যুগসমাপ্তির জয় দুন্দুভি বাজিয়ে যুগাতিক্ৰান্তী ভিন্নতর আদর্শের বার্তা ঘােষণা করেছেন। এখানেই কবি হিসেবে ভারতচন্দ্রের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অবক্ষয়-পর্বের শ্রেষ্ঠ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘অন্নদামঙ্গল'। ভারতচন্দ্রের কাব্যে যুগরুচির তৃপ্তি সাধনের চেষ্টা প্রকট। চতুর্দিকের সামাজিক ভাঙন কবিকে ধর্মমনস্কা থাকতে দেয়নি। তাই তাঁর কাব্যের দেবদেবী দৈব-পরিমণ্ডল ছেড়ে মর্ত্য পৃথিবীতে নেমে এসেছেন। তাঁরা মানবিক রসে জারিত। পূর্বতন ধর্মপ্রাণতার প্রতি কটাক্ষ আছে, শৃঙ্গার রসের বর্ণনায় কবি অত্যুৎসাহী। যুগের রুচিদুষ্টতার শিল্পমার্জিত রূপ পাওয়া যায় তাঁর কাব্যে।ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পর বাংলায় বিশুদ্ধ ধর্মীয় সাহিত্যকে বিদায় দিয়ে ধর্মের ক্ষীণ সূত্র নিয়ে কবিগান, তর্জা, আখড়াই, হাফ-আখড়াই,কৃষ্ণধামালি ইত্যাদি স্থূলরসের সাহিত্য রচনার আধিক্য দেখা দিয়েছিল।
COMMENTS