পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে কাশীরাম জন্মগ্রহণ করেন।এবং ষােড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে কাশীরামের মৃত্যু হয় । বাংলায় মহাভারতের
বাংলায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস
কাশীরাম দাস
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে কাশীরাম জন্মগ্রহণ করেন।এবং ষােড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে কাশীরামের মৃত্যু হয় । বাংলায় মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস। ষােড়শ শতকের একেবারে শেষে অথবা সপ্তদশ শতকের একেবারে গােড়ায় তিনি এই কাব্য রচনা করেন।কাশীরামের মহাভারতের নাম ভারত পাঁচালী। কাশীরাম দাস ব্যাসদেবের মহাভারত অনুবাদে হাত দিয়ে ছিলেন কিন্তু সম্পূর্ণ মহাভারত তিনি অনুবাদ করার আগেই মারা যান। তবে তারমধ্যে কয়েকটি অংশ তিনি অনুবাদ করে যান সেগুলি হল- আদি, সভা, বন ও বিরাট পর্বের কিয়দংশ ।তবে পরবর্তী সময়ে তার বংশের বিভিন্ন জন পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা মিলে তার পড়ে থাকা অসম্পূর্ণ অংশগুলি সম্পূর্ণ করেন।
কাশীরামের উপাধি ছিল ‘দেব'। মহাভারতের পুথিতে অবশ্য ‘দাস রয়েছে। কবির পরিবার বৈবভাবাপন্ন ছিলেন। তাই বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুসরণে ‘দাস' লিখেছেন।কাশীরামের গুরুর নাম অভিরাম মুখুটি। তাঁর আশীর্বাদেই কাশীরাম মহাভারতের অনুবাদ করেন।
কাশীদাসি মহাভারতের বৈশিষ্ট্য :-
কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর রচনা সংস্কৃত প্রভাবিত। মহাভারতে প্রচুর তৎসম শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের প্রয়ােগ ঘটেছে। অলংকারের আতিশয্যে কোথাও রচনা কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে রচনা সাবলীল গতিযুক্ত ও রসােত্তীর্ণ। তাঁর ভাষারীতিতে ক্লাসিক তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।
চৈতন্যোত্তর যুগের প্রেমভক্তির আদর্শ কবির জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। কাব্যে ভক্তিভাবুকতার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্যে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের যােগ্যতা বােঝাতে গিয়ে কবি তার ক্ষাত্রজনােচিত চরিত্রধর্ম ও শারীরিক সৌন্দর্যকে অনুপম ভাষায় ও অনুপ্রাসের ঝংকারে এক বর্ণদীপ্ত ভাবগাম্ভীর্যের শিল্পমূর্তি দান করেছেন। সেখানে বীরযােদ্ধ অর্জুন নবঘনশ্যামের মােহনমূর্তিতে রূপান্তরিত ।
কাশীরাম দাসের কৃতিত্ব :-
কাশীরাম দাস তাঁর রচনাকে ঘটনাবিন্যাসে, নাটকীয়তায়, সরস উক্তি-প্রত্যুক্তি ও হাস্যরস পরিবেশনে চিত্তাকর্ষী করে তুলেছেন। মহাভারতীয় রস ও ধ্বনিঝংকার অক্ষুন্ন রাখার জন্য অনুবাদ কর্মে তিনি প্রয়াসী হন। কাশীদাসি মহাভারত মূলানুগ ও সংস্কৃতগন্ধী হলেও তা দুর্বোধ্য ও নীরস হয়ে ওঠেনি।
মহাভারতের কাহিনিকে সরল করে কাশীরাম দাস তার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। লােকশিক্ষার জন্যই সামাজিক ও নৈতিক আদর্শ শিক্ষা সে যুগে বিশেষ প্রয়ােজন সেটা কাশীরাম দাস বুঝতে পেরেছিলেন। জনসাধারণের কাছে গুরুভার হবে বলেই তিনি মহাভারতীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দার্শনিক তত্ত্বকে তেমন বেশি অনুসরণ করেননি।
কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে পৌরাণিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হন। তাঁর রচনারীতিতে সংস্কৃত মহাভারতের তৎসমবহুল ক্লাসিক রীতির শব্দপ্রয়ােগ বেশি। তাই কৃত্তিবাসি রামায়ণের মতােকাশীদাসি মহাভারত সামগ্রিকভাবে বাঙালি ঘরের কাহিনি হয়ে ওঠেনি।
মহাভারতীয় রস ও মহাকাব্যিক পরিমণ্ডল সৃষ্টির জন্য কাশীরাম দাস ক্লাসিক আদর্শ অনুসরণ করেছেন সুপরিমিত ও সুবিহিত তৎসম শব্দ ও অলংকার প্রয়ােগে। অনুপম তনুশ্যাম নীলােৎপল আভা, ‘মহাবীর্য যেন সূর্য জলদে আবৃত’, ‘শ্রীবৎস কৌস্তভ মনি’ শশাভিত হৃদয় এবং ভারত পঙ্কর রবি মহামুনি ব্যাস প্রভৃতি পঙক্তিগুলিতে ক্লাসিক সাহিত্যের সুমহান অটল গাম্ভীর্যের সৌন্দর্যচ্যুতি ফুটে উঠেছে।
কাশীদাসি মহাভারত বাঙালিকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিপুল শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতাে এই গ্রন্থ কেবলমাত্র করুণরসের নিঝর নয়। বাঙালির ধ্যান-ধারণা ও ভাবকল্পনার সঙ্গে কাশীরাম দাস মহাভারতীয় ভাবাদর্শকে যথাসম্ভব মিলিয়ে দিয়েছেন।সভ্যতার রূপবদলের তালে তালে বাঙালি জীবনেও কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু কাশীদাসি মহাভারতের কাব্যরসধারা অন্তঃসলিলা ফক্মধারার ন্যায় বাঙালির অন্তৰ্জীবনে কুলুকুলু নাদে প্রবাহিত। কাশীদাসি মহাভারত বাঙালির জীবনগীতা—একটি বড়াে ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।
কাশীরাম দাসের রচনায় একদিকে মুকুন্দরাম প্রভৃতির স্বাভাবিকতা আছে, অন্যদিকে ভারতচন্দ্রীয় যুগের অলংকারের ঐশ্বর্যদীপ্ত সৌন্দর্যের এক অপরূপ সমন্বয় সাধিত হয়েছে। একদিকে অতীত যুগের তিনি ধারক ও বাহক, অপরদিকে পরবর্তী যুগের আভাসটুকুও তার মধ্যে অভিব্যক্ত।
COMMENTS