১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ধর্মই যে-কোনাে রাষ্ট্র গঠনের প্রধান শর্ত নয়, তা কয়েকবছরে
স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানে শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকা আলােচনা করাে ?
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ধর্মই যে-কোনাে রাষ্ট্র গঠনের প্রধান শর্ত নয়, তা কয়েকবছরের মধ্যেই পাকিস্তানে সুস্পষ্ট হয়ে যায়। সৃষ্টির কিছু কাল পরেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপর তীব্র অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা চাপিয়ে দেয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের পরিণতিতে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট হিসেবে বিভিন্ন ঘটনা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল যাকে কাজে লাগিয়ে জনদরদী নেতা শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ঠিক যে যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল সেগুলি হল—
➱ রাজনৈতিক বঞনা :- পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের তীব্র রাজনৈতিক বঞনার স্বীকার হয়। পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও তাকে কোনাে-না-কোনাে অজুহাতে পদচ্যুত করা হত। খাজা নাজিমুদ্দিন, মহম্মদ আলি বগুড়া, হােসেন শইদ সুরাবর্দি প্রমুখকে। এইভাবে পদচ্যুত হতে হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে ক্ষোভ জমে।
➱ অর্থনৈতিক শােষণ :- পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার বছর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য চাপিয়ে দেয়। মােট জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল। শিল্পায়ন না ঘটিয়ে সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তােলে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।
➱ সামরিক অসাম্য :- পাক সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা অবহেলিত ছিল। মাত্র ৫ শতাংশ বাঙালি পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীতে ছিল। কারণ পাক সরকার বাঙালিদের ভীতু বলে মনে করত। যে কারণে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাক যুদ্ধের ফলে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের নিরাপত্তাহীনতা আরও বৃদ্ধি পায়।
➱ মিথ্যা মামলা :- পূর্ব পাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামি লিগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান আন্দোলন শুরু করলে মুজিবর রহমান-সহ ৩৫ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে সরকার তাদের মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ফলে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র হয়ে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়।
➱ রাষ্ট্রভাষা উর্দু ও তার প্রতিক্রিয়া :- পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮.১৬ শতাংশের বেশি এবং উভয় পাকিস্তান মিলে ৫৬.৪০ শতাংশের বেশি মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অথচ পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করেন। জিন্নার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘােষণা করলে এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা রক্ষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস' হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এইরুপ একটি আন্দোলনকারীদের মিছিলে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি পাক এ সরকারের পুলিশ গুলি চালালে, সালাম, জব্বার, বরকত ও রফিক নামে চারজন যুবকের মৃত্যু হয়। তাদের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ বাঙালি জাতি ।যে পাক-বিরােধী আন্দোলন শুরু করে তা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।
➱ ১৯৭০-এর নির্বাচন :- ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতিমতাে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবরের নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১ টি আসন পায়। এইভাবে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া। আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে নতুন সংবিধান রচনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। নতুন সংবিধান রচিত হলে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া | খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে পূর্ব পাকিস্তান |অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে (১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ ১ মার্চ)।
➱ গণহত্যা :- পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও পূর্ববঙ্গের মানুষের উপর নৃশংসভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। পাক সেনাবাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসে পূর্ববঙ্গের মৌলবাদী আল-বদর, আল-সমাস প্রভৃতি রাজাকার বাহিনী। শান্তিপূর্ণ জমায়েত, গ্রাম বা শহরের লােকালয়ে,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ পাক বাহিনী উপস্থিত হয়ে ২৬৭ দিন ধরে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। এই গণহত্যায় মােট নিহতের সংখ্যা ১০-৩০ লক্ষ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। অন্তত ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিতা হন।
➱ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ;- ১৯৭১ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ব ।বাংলার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মুজিবর রহমান ৭ মার্চ ঘাষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। তার আগুন-ঝরা বক্তৃতায় বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন—“ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে, তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়াে।” ২৬ মার্চ মুজিবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ওই দিনই বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মুজিবরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
➱ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম :- ২৫ মার্চ মধ্যরাতে মুজিবর রহমানকে সরকার গ্রেপ্তার করতে পারলেও আন্দোলন দমন করতে পারেনি। পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই সময় বর্বর পাক হামলা থেকে বাঁচতে কোটি কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়।ফলে এই যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়ে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি মুক্তিযোেদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পাক সেনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজি ৯৩০০০ সৈন্যসহ ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলে দীর্ঘ ৯ মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়। ১৬ ডিসেম্বর।বাংলাদেশে বিজয় দিবস পালিত হয়।
➱ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন।বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির উদ্যোগে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তরিক মৈত্রী গড়ে ওঠে।
COMMENTS