১৯৮০-এর দশকে সার্ক-এর প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং অব-ঔপনিবেশিকরণের সূচনা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আলিক সহযােগিতা বাড়ানাের লক্ষ্যে
সার্ক কীভাবে গঠিত হয়েছিল ? সার্ক-এর উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্যতম ঐতিহাসিক ঘটনা হল ১৯৮০-এর দশকে সার্ক-এর প্রতিষ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং অব-ঔপনিবেশিকরণের সূচনা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আলিক সহযােগিতা বাড়ানাের লক্ষ্যে যে আন্দোলন চলে আসছে, সার্ক-এর প্রতিষ্ঠা সেখানে একটি স্থায়ী মাইলস্টোন হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট Association of South-East Asian Nations-প্রতিষ্ঠা ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যে কারণে তারা আলিক সহযােগিতা সংস্থা গঠনে উৎসাহী হয়েছিল। আর এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম উদ্যোগ নেন স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি চেয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে অর্থনীতি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদানপ্রদান ও যােগাযােগ সুদৃঢ় ও সহজলভ্য করার মাধ্যমে একে অপরের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক।
জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে দক্ষিণ-এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিদেশমন্ত্রীগণ পরবর্তী কয়েক বছরে কলম্বাে (১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ), কাঠমান্ডু (১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ), ইসলামাবাদ (১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ), ঢাকা (১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি সথানে একাধিকবার মিলিত হন। অবশেষে এই সব দেশের বিদেশমন্ত্রীরা ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে South Asian Association for Regional Cooperation বা সার্ক গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।অবশেষে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৭-৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই ৭টি দেশের শীর্ষনেতাদের নিয়ে এক শীর্ষ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট ঢাকাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হােসেন মহম্মদ এরশাদ প্রথম সার্ক সম্মেলনের উদবােধন করেছিলেন এবং তিনি সার্কের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সার্কের প্রথম মহাসচিব নিযুক্ত হন বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ আবুল আহসান। নেপালের রাজা বীর বিক্ৰম শাহ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি কাঠমাণ্ডুতে সার্কের স্থায়ী সচিবালয় স্থাপন করেছিলেন।
সার্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : সার্কের সনদে ঘােষিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলি ছিল—
⇶ উন্নয়ন : সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং সামাজিক উন্নয়ন ঘটানাে।
⇶ জনকল্যাণ : দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণসাধন এবং তাদের জীবনযাত্রার মানােন্নয়ন ঘটানাে।
⇶ নিরাপত্তা : দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদকে প্রতিরােধ করা।
⇶ বােঝাপড়া :- যে সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলি ছিল তাদের মধ্যে সেই সময় পারস্পরিক বিশ্বাস, বােঝাপড়া ও সংবেদন-শীলতার পরিবেশ তৈরি হয়ে ছিল।
⇶ আত্মনির্ভরতা : সার্কের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনতা রক্ষা এবং যৌথ আত্মনির্ভরতা গড়ে তােলা।
⇶ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান : সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ও পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটানাে।
⇶ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা : সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা এবং কোনাে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
⇶ আর্থসামাজিক আদানপ্রদান ; সামাজিক অর্থনৈতিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে পারস্পরিক আদানপ্রদান ও সহযােগিতা বৃদ্ধি করা।
⇶ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান : সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা। SAARC-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক বছর প্রতিটি দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা একটি বার্ষিক সম্মেলনে মিলিত হন। এইরকমভাবে সার্ক-এর প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায়। এর পর ভারতের ব্যাঙ্গালোের (১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ), নেপালের কাঠমাণ্ডু (১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ), পাকিস্তানের ইসলামাবাদ (১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ), মালদ্বীপের আন্দুসিটি (২০১১ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনগুলি অনুষ্ঠিত হয়।
সাফল্য : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার ক্ষেত্রে সার্কের প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সদস্য রাষ্ট্রগুলির নানাবিধ সমস্যার সমাধান এবং বিভিন্ন বিষয়ে সাফল্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এক্ষেত্রে সার্ক-এর সাফল্যের উল্লেখযােগ্য দিকগুলি হল—
(১) সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক আদানপ্রদান ও বাণিজ্যিক সহযােগিতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
২) সন্ত্রাসবাদ প্রতিরােধেও মােটামুটি সন্তোষজনক সাফল্য এসেছে। নেপালের কাঠমাণ্ডুতে সার্কের স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে সার্কের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৪) খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযােগিতা বৃদ্ধি পয়েছে। ৫ শিশুকন্যাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সার্কের সমস্যা বা ব্যর্থতা :- বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সার্কের প্রতিষ্ঠা হলেও বহু ক্ষেত্রে সার্ক তার লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার এই দিকগুলি হল—
A. রাজনৈতিক অস্থিরতা :- সেই সময়েদক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা সার্কের সাফল্যের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিবন্ধ-কতার সৃষ্টি করেছে। ভারত-পাক বিরােধ এ বিষয়ে একটি বড় বাধা।
B. তামিল জঙ্গিসমস্যা:- শ্রীলঙ্কার তামিল জঙ্গিদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঘটনায় শ্রীলঙ্কা সন্দেহ করে যে জঙ্গি কার্যকলাপের প্রতি ভারতের মদত রয়েছে। এই ঘটনায় ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
C. ভারসাম্যহীনতা :- ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শক্তি ও আর্থিক ব্যবধান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অসম বণ্টন সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করেছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলি ভারতের তুলনায় খুবই অনগ্রসর হওয়ায় নানাভাবে সার্কের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
E. সহযােগিতার অভাব :- সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অনেক সময় সহযােগিতার অভাবের ফলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে দেশগুলির উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না হলেও সার্ক এখনও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের ভুল নিজেরা আলােচনা করে | মিটিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। আর্থসামাজিক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়ণ করছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নতি তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
COMMENTS