জাতীর জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর ছেলেবেলা Mahatma Gandhi and his childhood as the father of the nation

জন্মঃ ২রা অক্টোবর ১৮৬৯ খ্রীঃ , মৃত্যু : ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ খ্রীঃ কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য মহাত্মাজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন-

জাতীর জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর ছেলেবেলা

জন্মঃ ২রা অক্টোবর ১৮৬৯ খ্রীঃ , মৃত্যু : ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ খ্রীঃ

কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য মহাত্মাজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন-

 “চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন,

হঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবন শুভক্ষণ

এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি।

রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজি।

এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার,

এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্যে পার।”



জাতীর জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধীর নাম আমরা সকলেই জানি। তাঁর ডাকে আসমুদ্র হিমাচলের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার যজ্ঞে আহুতি দিয়েছিলেন। অহিংস মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে অবাক করে দিয়েছিলেন। অসম সাহসী এই মহাত্মার জন্ম হয়েছিল ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২রা অক্টোবর। তাঁর জন্মস্থান গুজরাটের অন্তর্গত পোরবন্দর। গান্ধীজির বাবার নাম করমচাঁদ গান্ধী এবং মায়ের নাম পুতলিবাঈ।

ছোটো থেকেই মহাত্মা গান্ধী ছিলেন সৎ শোভন জীবনের প্রতীক।কাথিয়াবাড়ের একটি স্কুলে একদিন ইনসপেকটর এসেছেন, ছাত্রদের কেমন পড়াশুনা হচ্ছে তা দেখবার জন্য। একটি ক্লাসে এসে তিনি ছাত্রদের কয়েকটি ইংরাজি বানান লিখতে দিলেন। ওই ক্লাসের এক ছাত্র খাতায় একটি বানান ভুল লিখেছিল। ক্লাসের শিক্ষক’ মশাই তা দেখতে পেলেন। তিনি ছাত্রটিকে চোখের ইশারা করে বলেছিলেন, পাশের ছেলের খাতা দেখে বানানটি ঠিক করে টুকে নিতে। কিন্তু ছাত্রটি তা করল না। তার বানান ভুল রয়ে গেল।

ইনসপেকটর চলে গেলে মাস্টার মশাই ছাত্রটিকে তিরস্কার করে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কেন মাস্টারমশাইয়ের কথা শোনে নি। ছাত্রটি উত্তর দিয়েছিল অন্যের নকল আমি করব কেন? নকল করলে অন্যায় করা হবে এবং মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হবে।কিশোর ছাত্রের এই কথা শুনে মাস্টারমশাই লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন। ওই ছাত্রটি ছিলেন সত্যের পূজারী মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীজি নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই অমায়িক। তেরো বছর বয়েসে তখনকার নিয়মানুসারে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রীর নাম কস্তুরীবাঈ। এন্ট্রান্স পাশ করে মহাত্মা গান্ধী কলেজে এলেন। অনেকে বলেছিলেন তাঁকে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পাশ করতে। এইসময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। মা বিলেত যাওয়ার মত দিতে পারছিলেন না। গান্ধীজির ইচ্ছে ছিল, বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন। শেষ অব্দি অনেক বুঝিয়ে মায়ের সম্মতি নিলেন। ১৮৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, বিলেত যাত্রা করলেন। ১৮৯১ সালের ১০ জুন ব্যারিস্টারি পাশ করে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

গান্ধীজি ছিলেন খুবই লাজুক প্রকৃতির। ব্যারিস্টারি পাশ করে ফিরেছেন, অথচ মুখে কথার খই ফুটছে কই? আইনজীবী হিসেবে রোজগাড় করবেন কীভাবে? ধীরে ধীরে অবশ্য তিনি তাঁর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। বোম্বাইতে ওকালতি পেশায় বিশেষ সুবিধা না হওয়াতে চলে এলেন রাজকোটে। সেখানে থাকার সময় এক ইংরেজ সাহেবের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজ যতই ভদ্র হোক না কেন, তারা যে ভারতবর্ষের শাসক, সেই কথা তাদের আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই ঘটনায় গান্ধীজি শপথ নিয়েছিলেন, যে করেই হোক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।

ভাগ্যের কী লীলাখেলা- দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটা ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান “দাদা আব্দুল্লা এ্যান্ড কোং” তাঁকে ডেকে পাঠালেন। কিছু ফিসের বদলে এক বছরের মতো সেখানকার নাটাল প্রদেশে থেকে তাদের খরচে একটা মামলা করতে। মহাত্মা গান্ধী রাজী হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে গেলেন। সেখানে অবস্থানকালেই রাজনীতিতে প্রথম হাতেখড়ি হয় তার। অনেক ভারতীয় দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করতেন। কিন্তু তাদের চামড়ার রং কালো বলে সেখানকার ইংরেজরা তাঁদের ঘৃনা করত। তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করত, এইরকম অত্যাচারে প্রবাসী ভারতীয়দের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। অথচ উপযুক্ত নেতার অভাবে তারা বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারছিল না।

গান্ধীজি এগিয়ে গিয়ে সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন। আফ্রিকা সরকারের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে শুরু করলেন সত্যাগ্রহ। তাঁকে জেলখানায় যেতে হল। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার নতুন উদ্যমে আগ্রহ সহকারে আন্দোলনে যোগ দিলেন আবারও তাঁকে কারাবন্দি হতে হল। শেষপর্যন্ত তাঁর এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়েছিল। সেখানকার সরকার ভারতবাসীদের অনেকগুলি দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল।

১৯১৫ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে এলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালেন। নিজের চোখে দেখলেন সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। এই সময় ভারতের রাজনীতিতে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনও তপ্ত হয়ে উঠল। ১৯১৪ সালে মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল, ভারতীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা না হলে এই যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তারা কংগ্রেসের নেতাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিল। তারা বলল, ভারতীয় জনগণের উচিত, এখন ইংরেজের এই দুঃসময়ের দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। যুদ্ধের পরে ইংরেজ ভারতবর্ষকে স্বাধীন করে দেবে। গান্ধীজিও ইংরেজের এই চাতুরীপূর্ণ প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেছিলেন। মহাযুদ্ধ শেষ হল কিন্তু ইংরেজ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল না। ভারতবাসীদের ওপর অত্যাচার বেড়েই চলল। গান্ধীজি দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করলেন। শুরু হল অসহযোগ আন্দোলন এবং সত্যাগ্রহ।

১৯৩৯ সালে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এবারও ইংরেজরা প্রতিশ্রুতি দিল যুদ্ধে সাহায্য করলে তারা ভারতকে স্বায়ত্তশাসন দেবে। কিন্তু ভারতবাসীরা আর তাদের চাতুরিপূর্ণ কথা বিশ্বাস করেনি। ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট মহাত্মাজী ঘোষণা করলেন, “ইংরেজ ভারত ছাড়ো”। এই সঙ্গে তিনি বললেন-“করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে”, অর্থাৎ করব অথবা মরব। দেশের লোক নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠল। গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে সারা ভারতবর্ষে গণবিপ্লব দেখা দিল।

১৯৪৬ সালে ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা দাঙ্গা বেঁধে গেল। গান্ধীজি ছিলেন দাঙ্গাবিরোধী মানুষ। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতের বুকে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যেন সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। জীবনের ভয় উপেক্ষা করে তিনি দাঙ্গা বিধ্বস্ত অঞ্চলে গেলেন। শান্তি এবং অহিংসার বাণী প্রচার করতে থাকলেন। তাঁর এই শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচারের ফলে সেখানে শান্তি ফিরে এল।

১৯৪৭ খ্রীঃ ১৫ই আগস্ট ভারত দেশভাগের মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। সেই বছরেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য গান্ধীজির নোয়াখালি সফর ভারত ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা।স্বাধীনতা লাভের পর দেশ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল। গান্ধীজি তখন রাজনৈতিক জগত থেকে নিজেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করেছেন। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি এক প্রার্থনা সভায় অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধী এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। সমস্ত জীবন যিনি অহিংসার আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁর জীবন শেষ হল হিংসাত্মক আঘাতে।

গান্ধীজির জীবন দর্শন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি জাতির জনক রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাত্মা নামে ডাকতেন। কারণ, সত্য, প্রেম, ত্যাগ, সেবা ও অহিংসাকেই জীবনের মূলমন্ত্র মেনে নিয়ে সারাটা জীবনই খুব সহজ ও সরল জীবন যাপন করেছেন। আচার-আচরণের নির্ভীকতায় ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশে তিনি জনগণের বাপুজী হলেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সার্থক কর্ণধার। মহাত্মা গান্ধী আজও আমাদের মনের মণিকোঠায় এক উজ্জ্বল দীপশিখা হয়ে বেঁচে আছেন।

 


COMMENTS

নাম

Android,6,Computer,23,Internet,5,Mcq Seet,8,Mcq Test,2,Multimedia,3,Other,19,Poet,36,Police,1,Preparation,40,Quiz,2,Revolutionary,5,School,46,Scientist,4,Tet,6,Word,6,
ltr
item
Guides365: জাতীর জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর ছেলেবেলা Mahatma Gandhi and his childhood as the father of the nation
জাতীর জনক হিসেবে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর ছেলেবেলা Mahatma Gandhi and his childhood as the father of the nation
জন্মঃ ২রা অক্টোবর ১৮৬৯ খ্রীঃ , মৃত্যু : ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ খ্রীঃ কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য মহাত্মাজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন-
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEjqDG4hkqx-2olLkp7Yy2uSt9Y_21G9rd5mjQXnxYsZV3Vn5kaUq3wr9bzC6M9BXR0ZGGmke0qVK11domzl72BmwgQ7Kzrz6LylRM1g65fQvKrfV3AWq83QRY2mY-xp5M7IfqK_Gw71Vux4lsT7GRzp9lFfObUsyGFlK2-4LcTHnS7aBICwsDUGvxVw=w640-h480
https://blogger.googleusercontent.com/img/a/AVvXsEjqDG4hkqx-2olLkp7Yy2uSt9Y_21G9rd5mjQXnxYsZV3Vn5kaUq3wr9bzC6M9BXR0ZGGmke0qVK11domzl72BmwgQ7Kzrz6LylRM1g65fQvKrfV3AWq83QRY2mY-xp5M7IfqK_Gw71Vux4lsT7GRzp9lFfObUsyGFlK2-4LcTHnS7aBICwsDUGvxVw=s72-w640-c-h480
Guides365
https://www.guides365.in/2022/03/Revolutionary.html
https://www.guides365.in/
https://www.guides365.in/
https://www.guides365.in/2022/03/Revolutionary.html
true
1642768254594531261
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy