ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী ও গদ্য সাহিত্যে তার অবদান contribution to the biography and prose literature of Ishwar Chandra Vidyasagar
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী ও গদ্য সাহিত্যে অবদান
Contribution to the biography and prose literature of Ishwar Chandra Vidyasagar
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর :-
সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, পাণ্ডিত্য, দয়ার্দ্রচিত্ততা ও তেজস্বিতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের একক ব্যক্তিত্ব হলেন বিদ্যাসাগর । মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে । একজন শিক্ষকরূপে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন । বিদ্যাসাগরের প্রথম গ্রন্থ বাসুদেব চরিত । বিদ্যাসাগরের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থের নাম ‘বেতাল পবিংশতি' (১৮৪৭ খ্রিঃ)।হিন্দি ‘বেতালপচ্চীসী’ নামক গ্রন্থের অনুবাদ । শেকসপিয়রের ‘Comedy of Errors' গ্রন্থের অনুসরণে বিদ্যাসাগর ‘ভ্রান্তিবিলাস' (১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে) গ্রন্থটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং ঈশপের ফেবক্স অবলম্বনে বিদ্যাসাগর ‘কথামালা (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে) গ্রন্থটি গ্রন্থটি রচনা করেন । বিদ্যাসাগরের স্বরচিত জীবনচরিত গ্রন্থটির হোল 'বিদ্যাসাগর চরিত' যা ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় । নবজাত বাংলা গদ্যের সংস্কার সাধনের জন্য বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা গদ্যের জনকরূপে অভিহিত করা হয় । কঠোর সংগ্রামী, স্বাজাত্যাভিমানী, আপসহীন, সংবেদশীল হৃদয় ও সত্যানুগত্য প্রভৃতি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যাসাগরের গদ্য সাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে লেখা বিদ্যাসাগরের প্রথম সার্থক গদ্যগ্রন্থ শিল্পগুণসমৃদ্ধ বই ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি'। তিনি ‘বেতালপচ্চীসী’ নামে একটি হিন্দি বই থেকে এটি অনুবাদ করেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় ।
বিদ্যাসাগরের অনুবাদমূলক
গ্রন্থ
:-
‘বেতাল পঞ্চবিংশতি' (১৮৪৭), শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস’ (১৮৬০), “বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮), জীবন চরিত (১৮৪৯), ‘বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), ভ্রান্তিবিলাস’(১৮৫৯)।
বিদ্যাসাগরের মৌলিক
গ্রন্থ
:-
‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব' (১৮৫৩), দুই খণ্ডে 'বিধবাবিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫), দুই খণ্ডে বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক বিচার’ (১৮৭১, ৭৩), ‘অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩),‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪), ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ (আনুমানিক ১৮৬৩), বিদ্যাসাগর চরিত'।
মৃত্যুর পর
প্রকাশিত
গ্রন্থগুলি :-
‘প্রভাবতী সম্ভাষণ ‘ ও স্বরচিত জীবনী বিদ্যাসাগর চরিত'।
স্কুলপাঠ্য পুস্তক
:-
উত্তর ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’, ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’, ‘কথামালা' ইত্যাদি ।
বিদ্যাসাগরের বিচার-বিতর্কিতমূলক
রচনা
:-
বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতবিষয়ক প্রস্তাব’, ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব।
বাসুদেব চরিত' গ্রন্থ :-
১৮৪৭
থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিদ্যাসাগর অনেক গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন।১৮৪৭
খ্রিস্টাব্দেরও পূর্বে তিনি ভাগবতের কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে ‘বাসুদেব চরিত’ লিখেছিলেন, কিন্তু
দুঃখের বিষয় এই বই মুদ্রিত হয়নি। এর পাণ্ডুলিপিও মেলেনি ।
বাংলা সাহিত্যে গদ্যানুবাদে বিদ্যাসাগর
:-
বিদ্যাসাগরের
অনুবাদগুলি যথার্থ মৌলিক গ্রন্থের মত মর্যাদা পেয়েছে —কোন কোন টি প্রায়
ক্লাসিক সাহিত্যের পর্যায়ে উঠে গেছে। তিনি জানতেন—অনুবাদ ভিন্ন অতি দ্রুত গদ্যভাষা ও সাহিত্যের
উন্নতি অসম্ভব। সেইজন্য নিছক রসচর্চা ছেড়ে দিয়ে সারস্বত প্রতিভাকে তিনি অনুবাদকর্মে
নিয়োগ করেছিলেন। সাহিত্যগ্রন্থগুলির অনুবাদ স্বাভাবিক, সরস ও মূলানুগ হয়েছে—বলতে গেলে গদ্যানুবাদে
তাঁর মত কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যে অতি অল্প অনুবাদকই দেখাতে পেরেছেন ।
বিদ্যাসাগরের মৌলিক পুস্তিকা :-
সংস্কৃত
ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩), ‘বিধবাবিবাহ চলিত হওয়া উচিত
কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব' (প্রথম খণ্ড—১৮৫৫) (দ্বিতীয় খণ্ড—১৮৫৫), ‘বহু বিবাহ
রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক বিচার’ (প্রথম—১৮৭১, দ্বিতীয়—১৮৭৩), বিদ্যাসাগরচরিত
(১৮৯১),‘প্রভাবতী
সম্ভাষণ’
(আনুমানিক ১৮৬৩), ‘অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪), “র-পরীক্ষা
(১৮৬৬)।
‘প্রভাবতী সম্ভাষণ
গ্রন্থটির
বিষয়বস্তু
:-
বিদ্যাসাগরের বন্ধুর বালিকাকন্যা প্রভাবতীর শােচনীয় মৃত্যুশােকের বশে রচিত। তাঁর বিপুল মনস্বিতার অন্তরালে কতখানি স্নেহকাতর হৃদয় ছিল তা এই চোট্ট রচনাটি পড়লে বোঝা যাবে । রচনাটিতে বিদ্যাসাগরের শোকাপ্লুত হৃদয় আত্মপ্রকাশ করেছে ।
ছদ্মনামের আড়ালে
বিদ্যাসাগর
পুস্তিকা
রচনা
:-
অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), 'আবার অতি অল্প হইল' (১৮৭৩), এবং 'ব্রজবিলাস' (১৮৮৪) তিনখানি পুস্তিকা 'কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য এই ছদ্মনামে প্রকাশিত। 'রত্নপরীক্ষা' (১৮৮৬)‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপাে সহচরস্য' ছদ্মনামে প্রকাশিত । ছদ্মনামের অন্তরালে রচিত পুস্তিকাগুলিতে ও বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বহুবিবাহ নিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে প্রবল প্রতিপক্ষ খাড়া হয়েছিল, যাদের একমাত্র কাজ ছিল বিদ্যাসাগরের নামে অলীক কুৎসা প্রচার করা, তিনি ছদ্মনামে রচিত পুস্তিকাগুলিতে সরস ও ব্যঙ্গের ভাষায় সেই সমস্ত প্রতিবাদীর হাস্যকর অভিমত ছিন্ন ভিন্ন করে বিতর্কমূলক রচনায় অতি স্বাদু লঘু রসের স্পর্শ দিয়েছিলেন । এতে রঙ্গাব্যঙ্গ থাকলেও স্থূলতা নেই, সহজ হাস্যপরিহাস থাকলেও গভীর ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনার অভাব নেই । প্রসঙ্গত পুস্তিকাগুলি সম্পর্কে আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য : 'এরূপ উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাংলা ভাষায় অতি অল্পই আছে।
বাংলা গদ্যের জনক
কে
? বাংলা
গদ্যসাহিত্যে
তাঁর
অবদান
উল্লেখ
করে:-
বাংলা গদ্যের জনকত্ব নিয়ে প্রায়ই সুধীমহলে তর্কের ঝড় উঠে থাকে। কারও মতে, রামমোহন হন, আবার কারও কারও মতে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ সেই গৌরবের দাবিদার । কিন্তু প্রকৃতার্থে কেউ-ই বাংলা গদ্যের জনকত্ব দাবি করতে পারেন না, তাঁদের বরং পোষ্টা বলা যেতে পারে । বিদ্যাসাগর বাংলাগদ্যের শিল্পসম্মত রীতির উদ্ভাবয়িতা। আধুনিক কালের গদ্যে অনেক বৈচিত্র দেখা গেছে, কিন্তু পদান্বয় ও যতিবন্ধনে বিদ্যাসাগরকে আমরা ছাড়িয়ে নতুন পথ আবিষ্কার করতে পারিনি ।
ভ্রান্তিবিলাস' গ্রন্থঃ-
ভ্রান্তিবিলাস’ গ্রন্থটি ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত। গ্রন্থটি শেকসপিয়রের Comedy of Errors-এর গদ্যে অনুবাদ। শেকসপিয়রীয় বিদেশি কাহিনিটিকে দেশীয় পরিচ্ছদ দেবার জন্য নাটকে পাত্রপাত্রীর নামধাম পালটে তিনি ভারতীয় নাম দিয়েছেন ; ফলে বিদেশি কাহিনি একেবারে এদেশি রূপ ধরেছে ।
বাংলা সাহিত্যে
অন্যান্য
কবিদের
নিয়ে
আলোচনা |
গদ্যশিল্পী বিদ্যাসাগর
সম্পর্কে
কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ
কী
মন্তব্য
করেছিলেন
:-
গদ্যশিল্পী বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বহু পরিচিত মন্তব্যটি এরকম—‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের উদ্ধৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত ও সংযত করে তাকে সাবলীল গতি ও কার্যকুশলতা দান করেন। এখন তাঁর প্রদর্শিত পথেই বাংলা গদ্যের অনেক সেনাপতি কঠিন বাধা অতিক্রম করতে পারছেন। কিন্তু এই সেনানীর রচনাকর্তার, যুদ্ধজয়ের যশভাগ বিদ্যাসাগরেরই প্রাপ্য ।
বিদ্যাসাগর অনূদিত
শকুন্তলা'
গ্রন্থের
মূল
ভাব
বৈশিষ্ট্য
:-
মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলকে নাট্যরূপ থেকে আখ্যানরূপে ঢেলে সাজিয়েছেন বিদ্যাসাগর। নাটকে থাকে ঘটনার ইঙ্গিত—তার গোটা দেহ সংলাপ দিয়ে গড়া। বিদ্যাসাগর সংলাপ,বর্ণনা ও বিবৃতির সামঞ্জস্য বিধান করে গল্প বলার রীতির দিক থেকেও জাগ্রত চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাছাড়া শকুন্তলা কাহিনির কালিদাসসৃষ্ট কমনীয়তা, নিসর্গ মাধুর্য ও বেদনার সুর তিনি কতকটা রক্ষা করেছেন ।
অনুবাদকর্মে হলেও
‘ভ্রান্তিবিলাস'
গ্রন্থে
মৌলিকতা
কীভাবে
প্রকাশিত
:-
শকুন্তলা'র মত এই গ্রন্থেও (ভ্রান্তিবিলাস') নাটককে আখ্যানে রূপান্তরিত করা হয়েছে । কিন্তু আরও বেশি কিছু করা হয়েছে। ইউরোপীয় কাহিনি ও পাত্রপাত্রীকে তিনি দেশীয় পরিবেশে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। মনে হয় যেন আমরা প্রাচীন ভারতের কোন আখ্যান পড়ছি। বিষয়কে এরূপ মানানসই নতুন পোশাকে পরানো কম ক্ষমতার কথা নয় ।
বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ
অনুবাদকর্ম
:-
বিদ্যাসাগরের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকর্ম ‘সীতার বনবাস। এর প্রথমাংশ মাত্র ভবভূতির ‘উত্তমরামচরিত’থেকে গৃহীত। বাকি সবটাই রামায়ণ কাহিনির ভিত্তিতে নিজস্ব বিন্যাস ও সৃষ্টি ক্ষমতার প্রকাশ। নানা পরিস্থিতির উদ্ভাবন করে পাত্রপাত্রীর চিত্তলােকের বিশ্লেষণ করে বিদ্যাসাগর আগতপ্রায় উপন্যাস সাহিত্যের পূর্বসম্ভাবনাকে স্ফুরিত করেছেন এই রচনায় ।
বাংলা গদ্যের সংস্কারে
বিদ্যাসাগরের
অবদান
:-
(ক) বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার নিজস্ব পদসংস্থানরীতি আবিষ্কার করেছিলেন, (খ) বাংলা গদ্যের মধ্যেও ছন্দের অস্তিত্ব অনুভব করে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিরতির সাহায্যে এই গদ্যের মধ্যে প্রাণপ্রবাহ কল্লোলিত করেছিলেন। (গ) বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে প্রয়ােজনের সীমা ছাড়িয়ে রসের রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূর্বসূরিদের মত গালগল্পের প্রতি না ঝুঁকে কালিদাস- শেক্সপিয়রের ন্যায় উচ্চ প্রতিভার আশ্রয় নিয়েছিলেন ।
COMMENTS