বাংলা রামায়নের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা ও তার কৃতিত্ব The original poet of Bengali Ramayana is Krittibas Ojha and his achievements
বাংলা রামায়নের আদি কবি কৃত্তিবাস ওঝা ও তার কৃতিত্ব
The original poet of Bengali Ramayana is Krittibas Ojha and his achievements
কৃত্তিবাস ওঝা
কৃত্তিবাসের জন্মতিথি, শ্রীপঞ্চমী তিথি, মাঘ মাস, আদিত্যবার (রবিবার)। পঞদশ শতাব্দীর কবি কৃত্তিবাস ওঝা বাংলা রামায়ণের আদি কবি । আদিকবি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের অনুবাদ করেছেন ।বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক তথা বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ গণনা ও কুলজি গ্রন্থাদি বিচার করে অবশেষে এই সিদ্ধান্ত করেছেন যে, কৃত্তিবাস ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । নিজের জন্ম বিষয় কবি বলেছেন ‘আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস । কিন্তু কবি কোনো সাল তারিখ উল্লেখ করেননি । কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়—আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গেব । সামাজিক অথবা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে তাঁর পূর্বপুরুষ সপরিবারে গঙ্গা তীরবর্তী ফুলিয়া গ্রামে বসবাস করেন । তাঁরা ছিলেন মুখোপাধ্যায় ব্রাম্মণ । এক মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমীর পুণ্য তিথিতে কৃত্তিবাসের জন্ম । পিতা বনমালী, মাতা মালিনী । কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ (পিতা বনমালী ছিলেন নরসিংহের প্রপৌত্র) বারো বছর বয়সে বিদ্যার্জন সমাধা করে গৌড়েশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্বরচিত সাতটি শ্লোক তাঁকে শোনান । রাজা খুশি হয়ে কৃত্তিবাসকে সম্মানিত করেন এবং তখন থেকেই পণ্ডিত হিসেবে তাঁর খ্যাতি লাভ।
কবি
কৃত্তিবাস তিনি বাল্মীকির রামায়ণের ভাবানুবাদ করেছিলেন । তার
অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘রামায়ণ পাঁচালী
রামায়ণে গার্হস্থ্য চিত্র ও করুণ
রসের মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। সেজন্যই
রামায়ণ জাতিবর্ণনির্বিশেষে ভারতীয় হিন্দুদের ওপর চিরন্তন প্রভাব
বিস্তার করেছে । কোন্
রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় কৃত্তিবাস রামায়ণ লিখেছিলেন এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও সম্ভবত গৌড়েশ্বর
রুনুদ্দিন বরবক শাহর পৃষ্ঠপোষকতায়
কৃত্তিবাস রামায়ণ লিখেছিলেন । কৃত্তিবাসি
রামায়ণ -এ বীররসের
পাশাপাশি ভক্তিরস প্রাধান্য পেয়েছে। বাংলা
ভাষায় রামায়ণ
অনুবাদ করে কবি কৃত্তিবাস
ওঝা বঙ্গ সাহিত্যের ইতিহাসে
জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিলেন ।শিক্ষিত সম্প্রদায় ও কাব্যসমালচক দের মতে
কবি কৃত্তিবাস প্রায় সমস্ত রামায়ণের
সাত কাণ্ডই অনুবাদ করেছিলেন
। অনেকে মনে করেন রামায়ণ সাতটি কাণ্ডে বিভক্ত। অনেকে
আবার বলেন নয়টি কাণ্ডে
বিভক্ত । তবে
তাঁরা প্রক্ষিপ্ত অংশটিকেও বাল্মীকির রচনা বলে মনে
করেন ।
কৃত্তিবাসের রামায়ণ ১৮০২-১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে কৃত্তিবাসের রামায়ণ শ্রীরামপুরের পাদরিরা শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রকাশ করেন । ও শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮৩০-৩৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার-এর সম্পাদনায় কৃত্তিবাসি রামায়ণের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণে পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃপ্রেম, পতিনিষ্ঠা, পীপ্রেম ও বাঙালির বিবিধ নৈতিক আদর্শ এবং আধ্যাত্মিক এষণাকে কৃত্তিবাস সুললিত কাব্যরূপ দিয়েছেন ।প্রথম কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণী প্রকাশ করেন হারাধন দত্ত ভক্তনিধি ।কৃত্তিবাসি রামায়ণ আগাগোড়া পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। এ ছাড়া দলবৃত্ত (শ্বাসাঘাত প্রধান) ছন্দনৈপুণ্যও পরিদৃষ্ট।কৃত্তিবাস তাঁর কাব্য কাহিনি নির্মাণে স্কন্দপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, পদ্মপুরাণ, কূর্মপুরাণ, কালিকা পুরাণ, দেবী ভাগবত, জৈমিনি মহাভারত ও অদ্ভুত রামায়ণ প্রভৃতি পুরাণগ্রন্থের সাহায্য নিয়েছেন ।
কবি কৃত্তিবাসের মৌলিকতা
:-
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয়ের ভাষা ও প্রাণের আকুতি। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনি, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রগুলি অবিকৃত রেখে কৃত্তিবাস বাঙালির জীবনধর্মকে রসসৌকর্যে মণ্ডিত করে তুলেছেন। এখানেই তাঁর মৌলিকা।
কৃত্তিবাসি রামায়ণে
বাঙালিয়ানার
পরিচয়
:-
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। রাম-লক্ষ্মণের সৌভ্রাতৃত্ব, সীতার সর্বংসহ দুঃখময় বধূজীবন, হনুমানের দাস্যভক্তি, সুগ্রীব-বিভীষণের সৌহার্দ্য বাঙালি ঘরের জিনিস হয়ে উঠেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের চরিত্রগুলি কাশী-কোশল-মগধ-বিদিশা পরিত্যাগ করে বাঙালির গৃহাঙ্গনে অবতীর্ণ। কৃত্তিবাস বাঙালির মন নিয়ে বাঙালির মত করে বাঙালি জীবনের মহাকাব্য রচনা করেন।
কৃত্তিবাসের রামায়ণের
বৈশিষ্ট্য
:-
বাঙালি ও বাংলার কবি কৃত্তিবাস বাল্মীকিকৃত সংস্কৃত রামায়ণের কাঠামোর মধ্যে নিজের কবি কল্পনাকে মূর্ত করে বাঙালির মন নিয়ে বাঙালির মতো রামায়ণ রচনা করেছেন। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালি ভাবালুতা ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ । কৃত্তিবাসি রামায়ণের কয়েকটি বিশিষ্ট অংশ কোন্ কবির রচনা বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন সে বিষয়ে প্রচলিত কৃত্তিবাসি রামায়ণের কয়েকটি বিশিষ্ট অংশ (যেমন—অঙ্গ রায়বার, তরণীসেন বধ ইত্যাদি) কবিচন্দ্রের (শংকর চক্রবর্তী) রচনা বলে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, ডঃ সুকুমার সেন প্রমুখ সাহিত্যের ঐতিহাসিক-পণ্ডিতগণ মনে করেন। আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনা কৃত্তিবাসি রামায়ণ । গার্হস্থ্য জীবনাদর্শ ও সত্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির জাতীয় মহাকাব্য ।
কৃত্তিবাসের কাব্যমূল্য
বিচার
:-
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাল্মীকির ঘনপিনদ্ধ শিল্পরূপ তথা কাব্যমূল্য খোঁজা বৃথা। কৃত্তিবাস বাল্মীকি নন। কৃত্তিবাসি রামায়ণকে কৃত্তিবাসি স্বরূপে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের পরিচিত জীবন থেকে লৌকিক উপমা রূপকাদি ব্যবহার করে কৃত্তিবাস বক্তব্যকে খুবই তীর্যক ও তীক্ষ করে তুলেছেন। অলংকার প্রয়গে কবির কৃতিত্ব এই যে সংস্কৃত অলংকারের সঙ্গে দৈনন্দিন বাঙালির জীবন স্থান পেয়েছে। ফলে কৃত্তিবাসের সৃজনশীল প্রতিভা শিল্পসৌকর্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে ।
বাংলা সাহিত্যে
অন্যান্য
কবিদের
নিয়ে
আলোচনা |
|
বাঙালি জীবনে
জনপ্রিয়তার
কারণ
:-
বাঙালি জাতির অন্তরে কৃত্তিবাসি রামায়ণ চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে। আর্য রামায়ণ যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছিল, তেমনি কৃত্তিবাসি রামায়ণ বাংলাদেশকে শান্ত স্নিগ্ধ জীবনাদর্শের মধ্যে নির্ভয় আশ্রয় দিয়েছে। সেজন্য, বাঙালি জীবনের ওপর দিয়ে নানা সংকট ও ঝড়-ঝঞ্জা বয়ে গেলেও, জীবনের মূল্য সম্বন্ধে এ জাতির আমূল মানসিক পরিবর্তন হয়নি। বাঙালির দৈনন্দিন জীবন ও মানসিক ঐতিহ্যের প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গে কৃত্তিবাসি রামায়ণ ওতপ্রাত-ভাবে জড়িয়ে গেছে । তাই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এই কাব্য অখণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
কৃত্তিবাসের রামায়ণ
মহাকাব্য না
পাঁচালি
:-
প্রাচীনযুগে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী কাব্য বলেই পরিগণিত হত। সুর করে টেনে টেনে পদ্যপাঠের রীতিকে পাঁচালি বলে। মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত কাব্যই পাঁচালির ঢঙে লেখা হত। মহাকাব্যের ধারণা সে যুগে ছিল না। তা ছাড়া পশ্চিম ও ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের নিয়ম অনুসরণ করে কাহিনি, চরিত্র, রসের ঐক্য ও রচনার উৎকর্ষ যদি বিচার করা যায়, তাহলে এই কাব্যকে যথার্থ মহাকাব্যও বলা যায় কিনা সন্দেহ। অথচ আধুনিক কালের অনেক পণ্ডিত কৃত্তিবাসের রামায়ণকে মহাকাব্য বলার পক্ষপাতী। সুতরাং, এটি একটি অমীমাংসিত বিতর্কিত বিষয় ।
COMMENTS